ছেলেবেলায় সরস্বতী পুজো একেবারে অন্যরকম ছিল। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়তাম। কাকিমারা ছোটদের গায়ে হলুদ মাখিয়ে দিতেন। ভাইবোনেরা সকলে হলুদ মেখে রোদের মধ্যে ঘুরতাম। তারপর লাইন দিয়ে একে একে সকলকে স্নান করানো হত। তারপর পাঞ্জাবি পরতে বলা হত। এখন তো পাঞ্জাবি ছাড়া সেভাবে কিছু পরি না। কিন্তু, তখন বিষয়টি একেবারেই উলটো ছিল। আমি একেবারেই পাঞ্জাবি পরতে চাইতাম না। কিন্তু, ওই একটা দিন বাড়ির সকলকে পাঞ্জাবি পরতেই হবে। একদম ম্যান্ডেটরি ছিল এটা। বাড়িতে পুজো হত। অঞ্জলি দিতাম সকলে মিলে। পরে তো বাড়িতে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। তখন পাশের বাড়িতে কিংবা সামনের বাড়িতে অঞ্জলি দিতে যেতাম। অঞ্জলি দেওয়ার পর প্রথম যেটা খেতাম, সেটা হল কুল। সরস্বতী পুজোর আগে তো কুল খাওয়া যেত না। তাই পুজো হওয়া মাত্রই কুল খেতাম। একটা মজার প্রশ্ন সে সময় থেকেই আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। সরস্বতী পুজোর কতদিন আগে থেকে কুল খেতে নেই? আর পুজোর পর কতদিন পর্যন্ত কুল খাওয়া যায়? এখনও অবশ্য এর উত্তর পাইনি। তবে জানার ইচ্ছে আছে।
বাড়ির পুজো পর্ব শেষ করে স্কুলে যেতাম। সেখানে বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে খিচুড়ি আলুরদম খেতাম। একটু বড় হওয়ার পর যখন বাইরে একটি আধটু বেরনোর অনুমতি পেতাম, তখন পাড়ার আশেপাশেই ঘুরতাম। পরবর্তীতে কলেজেও একইভাবে মজা করেছি। কলেজেই থাকতাম। আসলে সরস্বতী পুজো নিয়ে বরাবরই উন্মাদনা রয়েছে পড়ুয়াদের মধ্যে। আমার মধ্যেও ছিল। কিন্তু, আমি বরাবরই একটু লাজুক প্রকৃতির। তাই মেয়েদের স্কুলে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া বা কারও হাত ধরে ঘোরার অভিজ্ঞতা সেভাবে নেই। দেখতাম, মূলত ডেপো রাই ওই নিমন্ত্রণ করতে যেত। তবে কোনও গার্লস স্কুলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কারও চোখে চোখ পড়ে গেল। এমনটা হয়নি তা নয়। একটা দিন যেমন আনন্দ হয় আরকি। মেয়েরাও শাড়ি পরত। আমরাও পাঞ্জাবি পরে থাকতাম। ওরাও আমাদের স্কুলের পাশ দিয়ে যেত। আমরাও যেতাম। তাছাড়া সরস্বতী পুজোয় বিভিন্ন স্কুল থেকেও নিমন্ত্রণ আসত।
অনেকেই বলেন সরস্বতী পুজো বাঙালির প্রেমের দিন। তবে আমার সেটা মনে হয় না। প্রেমের কোনও বিশেষ দিন হয় না। সবদিনই প্রেমের। হ্যাঁ, অনেকে বাড়ি থেকে একদিনই বেরতে পারত, তাঁদের ক্ষেত্রে হয়ত হাত ধরে ঘোরার একটাই দিন ছিল। আমি কখনও বান্ধবীর হাত ধরে ঘুরেছি এমনটা নয়। সেভাবে কোনওদিনই কিছু হয়নি। আজও আমি সিঙ্গল।
তবে ঠাকুর দেখেছি নিয়ম করে। বালিতে মেকল বলে একটা স্কুল রয়েছে। সেখানে জলের ঠাকুর হত। মানে জলাশয়ের উপরেই পুজো হত। সেটা দেখার জন্য একেবারে মুখিয়ে থাকতাম। দু’ থেকে তিনদিন থাকত ওই প্রতিমা। লাইন দিয়ে ঠাকুর দেখতাম।
আজকালকার সরস্বতী পুজো তো আর আগের মত নেই। সকাল সকাল উঠে কে গায়ে হলুদ মাখবে এখন? এখন তো রাতে ভিডিয়ো গেম খেলে দেরি করে ঘুমাতে যায় ছেলেমেয়েরা। আর সকালেও দেরি করে ওঠে। কুল যে সরস্বতী পুজোর আগে খেতে নেই, সেই রীতির কথা কতজনের মনে আছে বলুন তো?