কোচবিহারের লোকগাথা অনুসারে জানা যায়, কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহ শৈশবকালে তার তিন ভাই শিষ্যসিংহ, কুমার চন্দন ও কুমার মদন এবং শৈশবের খেলার সাথীদের নিয়ে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আসামের ‘চিকনা’ নামক গভীর বনে ময়না কাঠের ডালকে দেবী দুর্গা কল্পনা করে বনফুল, ফল দিয়ে পুজো করেছিলেন। প্রচলিত আছে যে, খেলার এক সাথীকে রাজকুমার শিষ্য সিংহ পাঠার মতো আটকে রাখেন এবং মহারাজা বিশ্বসিংহ কুশ দিয়ে আঘাত করা মাত্রই দেবীর অলৌকিক ক্ষমতায় সেই বন্ধুর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে যায়। মহারাজা বিশ্বসিংহ সেই বন্ধুর ধরহীন মাথা দেবীর নামে নিবেদন করেন।
কথিত আছে যে, সেই সময় দেবী দুর্গার আশীর্বাদেই নাকি মহারাজা বিশ্বসিংহ ‘চিকনা’র অধিপতি তুরকা কোতোয়ালকে পরাজিত ও নিহত করে কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হন। দেবী দুর্গা সেই সময় নিজের হাতের কঙ্কন ও তীক্ষ্ণ খড়্গ উপহার দেন মহারাজা বিশ্বসিংহকে।
সেই সময় ময়না গাছের ডালকে দেবী দুর্গা কল্পনা করে পুজো হয়েছিল বলে আজও রাধা অষ্টমীর পুন্যতিথিতে ময়না গাছের ডাল পুজো করে দেবীপ্রতিমার শক্তিগোজ করা হয়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জানা যায়, মহারাজা বিশ্বসিংহের পুত্র কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ণ স্বপ্নাদেশে স্ববংশে দশভূজা দুর্গা মূর্তির পুজোর প্রচলন করেন। কোচবিহারের ইতিহাস মতে, মহারাজা নরনারায়ণের ভাই সেনাপতি চিলা রায় নিজের বীরত্বে গর্বিত হন। এবং তার মনে কোচবিহারের সিংহাসনে বসবার লোভ তৈরি হয়।
একদিন তিনি দাদা নরনারায়ণকে হত্যা করবার উদ্দেশ্য নিয়ে রাজসভায় যান কিন্তু, সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি দেখতে পান যে, স্বয়ং ভগবতী দুর্গা দশ হাত দিয়ে ঘিরে রক্ষা করছেন রাজা নরনারায়ণকে। চিলা রায় এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লজ্জায় দাদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু, এই ঘটনায় নরনারায়ণ নিজেকে ভাগ্যহীন মনে করেন এবং চিলা রায়কে ভাগ্যবান মনে করেন।
নিজের ভাগ্যে দেবী দর্শন না ঘটায় মনের দুঃখে অন্ন জল ত্যাগ করে নির্জনবাস করতে আরম্ভ করেন নরনারায়ণ। জনশ্রুতি আছে যে এই ঘটনার ৩ দিন পর গভীর রাতে দেবী দুর্গা নরনারায়ণকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন, ‘বৎস ওঠ, জগৎ সংসার আমার যে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পুজো করে তা প্রত্যক্ষ কর। শরৎকালে তুমি এই মূর্তি নির্মাণ করে যথাবিধি পুজো করবে।’
বলেও দেবী আদেশ দেন তাকে। এরপরই, মহারাজা নরনারায়ণ চোখ খুলে ভগবতীকে দর্শন করে প্রনাম ও স্তুতি করে বলেন, ‘মা, মহিষাসুরের ডান হাত সিংহ দন্তাঘাত করে আছে, কিন্তু তাঁর বাম হাত শূন্য রয়েছে।’ দেবী দুর্গা তখন বললেন-‘ওই স্থানে একটি বাঘ দিও।’ রাজা নরনারায়ণ দেবীর অতসী কুসুমাকার বর্ণ দেখে মনে করলেন ভগবতী দেবী দুর্গার লাল রং হলে ভালো হয়। মহারাজা নরনারায়ণ সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তি স্থাপণ করে শারদীয়া দুর্গা পুজোর প্রচলন করেন।
কোচবিহার রাজবাড়ীর বড়দেবী দুর্গার চেহারা বেশ ভীতি উদ্রেককারী। তাঁর গায়ের রঙ লাল, তাঁর দ্বারা দলিত অসুরের গায়ের রঙ সবুজ। দেবীর বাহন সিংহ অসুরের পায়ে কামড়ে ধরে রয়েছে। আর অসুরের হাতে কামড় বসিয়েছে একটি বাঘ। দেবীর দুপাশে অবস্থান করছেন, দেবীর দুই সখি— জয়া ও বিজয়া। বলাই বাহুল্য এই মূর্তি মহারাজা নর নারায়ণের স্বপ্নে দেখা দেবী দুর্গার রক্তবর্ণ রূপের প্রকাশ।
কাল প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেদিনের রাজতন্ত্র থেকে আজ কয়েক যোজন দূরে অবস্থান করছে কোচবিহার। কিন্তু আজও বন্ধ হয়নি বড়দেবী দুর্গা পুজো। আজও ঐতিহ্য বহন করে চলেছে সেই পুজো। এই পুজো আজও কোচবিহারে রাজবংশের নিজস্ব পুজো। এখন দেবোত্তর ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই এই পুজো হয়।