Coochbehar Rashmela: চাচার দোকানে গীতা কিনতে ভিড় কোচবিহার রাসমেলায়

মদনমোহন মন্দিরের সামনে বৈরাগী দিঘির উত্তর-পূর্ব কর্নারে রাস্তার ধারে রাসমেলার ভিড়ে এক কোণে বসে আছেন ৭০ বছরের এক মুসলিম বৃদ্ধ – ছাটা গোঁফ মুখে সাদা লম্বা দাড়ি, চোখে এক অদ্ভুত শান্তি।

চেহারায় এক নজরে ফুটে ওঠে তিনি মুসলিম।

আর সেই মুসলিম ভদ্রলোকের দোকানে সাজানো সারি সারি শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতা সহ হরেক রকম গীতা। বাংলা গীতা থেকে গীতা প্রেসের অনুবাদ, অধ্যাত্ম রামায়ণ সহযোগে গীতা, যথাযথ গীতা,গীতা–তত্ত্ব, কল্যাণী গীতা, গীতার বাংলা সরল ব্যাখ্যা – যত রকম বাংলা গীতা বাজারে পাওয়া যায়, প্রায় সবই আছে তাঁর দোকানে। দোকানদারের নাম – তসলিম শেখ।

কোচবিহার জেলার দিনহাটার সাহেবগঞ্জ গ্রাম থেকে চার দশক ধরে বই বিক্রি করে সংসার চালানো মানুষটি এবারে কোচবিহারের ২১৪তম রাসমেলাতে এসেছেন আগের মতোই—হাতে গীতা, মনে সম্প্রীতি। তাঁর দোকানের ৯০ শতাংশই গীতা। বাকিটা রামায়ণ–মহাভারত, লক্ষ্মী-পাঁচালি, শিব–দুর্গা–কৃষ্ণ–হনুমান রামচন্দ্র–গণেশের বাধাই করা রঙিন ছবি। ক্রেতাদের প্রায় সবাই হিন্দু। আর প্রত্যেকে এসে তাকে ডাকছেন “চাচা”।

আর এই চাচার সম্মোধন শুনে তিনি খুশি হন।

তসলিম বলেন , “মুসলিম হয়ে গীতা বিক্রি করি বলেই হিন্দু মানুষ জন আরো খুশি, কেউ কোনদিন আমাকে তারা কেউ কখনো আমাকে কটু কথা বলেনি ”

মুখে বিনয়ী হাসি নিয়ে তসলিম বলেন, “দেখুন তো, মায়েরা–বোনেরা এসে আমাকে ‘চাচা’ বলে ডাকছে। সম্মান দিচ্ছে। মুসলিম হয়ে গীতা বিক্রি করি বলেই ওরা একটু বেশি খুশি। আমি যদি অন্য ধর্মকে সম্মান দিই, তারা আমাকেও সম্মান দেয়—এইটুকু জীবনে শিখেছি। অল্প স্বল্প লেখাপড়া শিখেছি বেশিদূর পড়তে পারিনি, অত কিছু ভাবনা-চিন্তা করে এসব তো শুরু করিনি, বইয়ের বইয়ের দোকান করি মেলায় মেলায় এটাই আমার পরিচয়। ”

গীতা–বিক্রেতা মুসলিম বৃদ্ধের এই দর্শন আসলে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি।

৪০ বছর ধরে এক মেলা থেকে অন্য মেলায় রাত কাটিয়ে তিনি দেখেছেন—মানুষ ধর্মে নয়, আচরণে মানুষকে চেনে।

তসলিমের কথায়, “আমি ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করি না। বই বিক্রি আমার রোজগার। কিন্তু গীতার বই পড়তে ভালো লাগে। বাংলায় লেখা যে গীতাগুলো আছে, সেগুলো আমি পড়েছি। ধর্মীয় গ্রন্থ মানুষকে উদার হতে শেখায়। তার পরিবারে স্ত্রী জায়দা বিবি, ছেলে–বউমা, নাতি। ছেলে জুয়েল হক দিল্লিতে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। তসলিমই এখনো পরিবার, আত্মীয়–স্বজনের সিংহভাগের খরচ চালান মেলা–মণ্ডপে গীতা–রামায়ণ বিক্রি করে।

শুধু তসলিম শেখ ই নন এই বছর রাসমেলায় আরো চারটি মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ রাস মেলা ময়দানে ধর্মগ্রন্থের পৃথক পৃথক দোকান দিয়েছেন।

তসলিম জানান, আনারুল আজাদ, আজিবুল শেখ, নুর ইসলাম শেখ, মজিবার রহমান—সবাই তাঁর নিকট আত্মীয়। প্রতেকেরই নিজস্ব স্টল আছে। সকলেই বই কিনে আনেন কলকাতার প্রকাশকদের কাছ থেকে।

 

“আমাদের পাঁচজনেরই আলাদা দোকান। আমরা সবাই বই বিক্রি করে সংসার চালাই। এটা আমাদের পেশা ও গর্ব,” বললেন তসলিম। গড় বিক্রি ৭–৮ হাজার টাকা, লাভ থাকে আড়াই হাজার

রাসমেলায় প্রতিদিন তাঁর দোকানে বিক্রি হয় ৭–৮ হাজার টাকার বই। লাভ থাকে আড়াই হাজারের মতো।

স্থায়ী কোনো দোকান নেই। যেখানে মেলা বসে—সেখানেই তাঁরা চলে যান।

“রাতে এই দোকানেই ঘুমাই। এটাই আমার কর্মক্ষেত্র, এটাই আমার সংসার,” বললেন তিনি।

‘ধর্মের বিভেদের যুগে তসলিম শেখেরা সম্প্রীতির বাতিঘর’

রাসমেলা দেখতে আসা এক স্কুলশিক্ষিকা তসলিমের দোকান থেকে বই কিনছিলেন।

তিনি বলেন,, “মুসলিম একজন বৃদ্ধ গীতা বিক্রি করছেন—এটা দেখেই কৌতূহল হয়। এটাই তো আমাদের ভারতবর্ষের আসল ছবি হিন্দু মুসলমান ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের দেশ সম্প্রীতির দেশ আমাদের পশ্চিমবঙ্গ সম্প্রীতির জায়গা।”

এক মহিলা একটি ছোট আকারের গীতা কিনে বললেন, “দেশ যখন ধর্ম নিয়ে সংঘাতে জড়াচ্ছে, তখন কোচবিহারে সম্প্রীতির নিদর্শন দাঁড়িয়ে আছে তসলিম শেখরা। এঁরা আমাদের সত্যিকারের ভারতীয় চেতনার মুখ।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest Articles